ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (ইংরেজি: Secularism) শব্দটির বিস্তৃত অর্থ রয়েছে। তবে ধর্মনিরপেক্ষবাদ বলতে সাধারণত রাষ্ট্র আর ধর্মকে পৃথকরূপে প্রকাশ করাকে বোঝায়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে ধর্ম বা ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে থেকে পরিচালনা করাকে বোঝানো হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আইন কোন নির্দিষ্ট ধর্মের উপর নির্ভরশীল থাকেনা।
সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা কী?
যে মতবাদটিকে ইংরেজিতে secularism বলা হয় তার আরবি প্রতিশব্দ হিসেবে বহুলভাবে علماني [‘আলমানি] শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আর বাংলায় এর (সত্যের অপলাপকৃত) অনুবাদ করা হয় ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ শব্দ দিয়ে। তাহলে দেখা যাক সে সেকুলারিজম (বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা) কী? ছোট্ট একটি প্রশ্ন, কিন্তু তার উত্তর চাই স্পষ্ট, নিখুঁত ও বিস্তারিত। এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর প্রত্যেক মুসলিমের জানা-থাকা জরুরি। আল্লাহর মেহেরবানী যে, এ পর্যন্ত সেকুলারিজমের উপর বহু গ্রন্থ লিখা হয়েছে, আমাদের কর্তব্য শুধু জানা ও আমল করা।
এবার প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করি, তবে এ জন্য আমাদের বেশী কষ্ট করতে হবে না, কারণ যেখানে ‘সেকুলারিজম’ বা তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ মতবাদের জন্ম, সে পাশ্চাত্য দেশসমূহে লিখিত অভিধানগুলো আমাদেরকে সেটার অর্থ খোজা ও সন্ধান করার কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়েছে। ইংরেজি অভিধানে secularism শব্দের নিম্নরূপ অর্থ এসেছে:
১. পার্থিববাদী অথবা বস্তুবাদী।
২. ধর্মভিত্তিক বা আধ্যাত্মিক নয়।
৩. দ্বীনপালনকারী নয়, দুনিয়াবিমুখ নয়[1]।
একই অভিধানে secularism শব্দের সংজ্ঞায় এসেছে:
“secularism এমন একটি দর্শন, যার বক্তব্য হচ্ছে, চরিত্র-নৈতিকতা ও শিক্ষা ধর্মীয় নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না”।
‘ব্রিটিশ বিশ্বকোষ’-এ আমরা দেখি, সেখানে সেকুলারিজম সম্পর্কে বলা হয়েছে: “সেকুলারিজম একটি সামাজিক আন্দোলন, যার একমাত্র লক্ষ্য মানুষদেরকে পরকালমুখী থেকে ফিরিয়ে এনে দুনিয়ামুখী করা”।
Encyclopedia Britanica নামীয় ব্রিটিশ বিশ্বকোষে Atheism বা ‘নাস্তিকতা’ শিরোনামের অধীন secularism এর আলোচনা এসেছে। তাতে Atheism তথা নাস্তিকতাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে:
১. তাত্ত্বিক নাস্তিকতা (إلحاد نظري)
২. ব্যবহারিক নাস্তিকতা (إلحاد عملي)।
‘বিশ্বকোষ’ সেকুলারিজমকে দ্বিতীয় প্রকার নাস্তিকতার অন্তর্ভুক্ত করেছে।[2] এ আলোচনা থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট হল:
এক. সেকুলারিজম একটি কুফরি দর্শন, তার একমাত্র লক্ষ্য দুনিয়াকে দ্বীনের প্রভাব মুক্ত করা। সেকুলারিজম একটি মতবাদ, তার কাজ হচ্ছে পার্থিব জগতের সকল বিষয়কে ধর্মীয় বিধি-নিষেধ থেকে মুক্ত রেখে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, আদর্শিক ও পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার নিজের তৈরি বিধান দেওয়া ও সকল স্তরে নেতৃত্ব প্রদান করা।
দুই. সেকুলারিজমের সাথে জ্ঞান বা বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই, যেমন কতক কুচক্রী মানুষদেরকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলার জন্য বলে, সেকুলারিজম অর্থ ‘ব্যবহারিক বিজ্ঞানের উপর গুরুত্বারোপ ও তার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা’। এ বক্তব্যের অসারতা ও সত্য গোপন করার অপকৌশল আমাদের বর্ণিত অর্থ থেকে স্পষ্ট, যা আমরা গ্রহণ করেছি ‘সেকুলারিজম’ এর সুতিকাগার থেকে, যে সমাজে তার জন্ম ও পরিচর্যা হয়েছে।তাই ‘সেকুলারিজম’ এর অর্থ যদি করা হয় ধর্মহীনতা, তাহলে তার সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা ও সঠিক অর্থ প্রকাশ পাবে এবং তাতে অপলাপের কিছু থাকবে না, বরং যথার্থ অর্থই স্পষ্ট হবে।
সেক্যুলার বলতে কাদের বোঝানো হয়?
সাবেক মিশরীয় রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাতের হত্যাকারীকে প্রশ্ন করেছিলেন বিচারক- “প্রেসিডেন্ট সাদাতকে কেন হত্যা করেছ তুমি?
হত্যাকারী জবাব দিয়েছিল- “কারণ সে সেক্যুলার ছিল।” বিচারক তখনই পরের প্রশ্নটি করলেন- “সেক্যুলার মানে কী?”
হত্যাকারী জানালো- “আমি জানি না।”
প্রয়াত মিশরীয় লিখক নাগিব মাহফুজকে ছুরি মেরে হত্যা-চেষ্টাকারীর একজনকে প্রশ্ন করেছিলেন বিচারক- “নাগিব সাহেবকে তুমি ছুরিকাঘাত করেছ কেন?”
জবাবে সন্ত্রাসী বলেছিলো- “কারণ সে ধর্মবিরোধী ‘চিলড্রেন অভ গেবালাবি’ উপন্যাসটি লিখেছে।
বিচারক আগ্রহ দেখালেন- “উপন্যাসটি পড়েছ তুমি?”
অপরাধী জবাব দিয়েছিলো- “না।”
মিশরীয় সাহিত্যিক ফারাজ ফাউদাকে হত্যাকারী সন্ত্রাসীটিকে বিচারক প্রশ্ন করেছিলেন- “ফারাজ ফাউদাকে মেরে ফেললে কেন?”
হত্যাকারী জবাব দিয়েছিল- “কারণ তার ঈমান নাই।”
বিচারক জানতে কৌতূহলী হলেন- “তুমি কিভাবে বুঝলে যে তাঁর ঈমান নেই?”
সন্ত্রাসীর জবাব ছিল- “তার বইগুলা পড়লেই সব বোঝা যায়।”
বিচারকের কৌতূহল বেড়ে গেলো- “তাঁর কোন্ বইটিতে তুমি তাঁর ঈমানহীনতার প্রমাণ পেলে?”
হত্যাকারী স্বীকার করলো- “বইয়ের নাম আমি জানি না। আমি পড়িনি ওসব।”
বিচারক বিস্মিত হলেন- “কেন পড়োনি?”
খুনীটি বলেছিলো- “আমি লিখতে-পড়তে জানি না।”
ঘৃণা, কখনোই জ্ঞানের মাধ্যমে ছড়ায় না। ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ে অজ্ঞতার মাধ্যমে। সমাজ অজ্ঞতার খেসারত, অজ্ঞ করে রাখার খেসারত, এভাবেই দেয়।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।